চালকের লাইসেন্স ছিল না, তাই যে ছেলেটি জেগেছিল, সেই ছেলেটি বাঁচল না। যে ছেলেটি কয়েক মাস আগে নিরাপদ সড়ক আর সুবিচারের দাবিতে হাসিমুখে নেমেছিল রাস্তায়, সেই ছেলেটিকে পিষে গেল বাস। এক ঘটনায় এক মাসুম মারা গেল, এক পিতা সন্তানহারা হলো আর দোষী হয়ে গেল সেই বাসচালক। অথচ তিনজনেরই জীবনের দাবি তো সমান হওয়ার কথা, তিনজনেরই তো নিরাপদ ও নির্দোষ থাকার দরকার ছিল। কাকে কী বলব? কিছুতেই তো কিছু হয় না, কেবল অকাতরে প্রাণ ঝরে যায়, আশা মরে যায়। প্রাণের প্রশ্নটা ছেলেমেয়েরা একদম প্রাণ থেকেই তুলেছে: এর পরের জন কি আমি???
কী বলিব সোনার চান্দ রে আবরার, কী বলিব রে আর। আমাদের নাই জীবনের লাইসেন্স, চালকের নাই গাড়ি চালানোর লাইসেন্স, কর্তৃপক্ষের কী আছে কী নাই, তা তো জীবন দিয়ে জানছি।
রাষ্ট্র-সরকার যাঁরা চালান, তাঁরা অতি পাষাণ হয়ে গেছেন কি? পাথরে আঘাত করলে প্রতিধ্বনি আসে, আর নিহত সন্তানের পিতাকে শুনতে হয়, কাঁদবেন না, আপনার ছেলের নামে একটা ফুটওভার ব্রিজ করে দেব। আপনি এসে দয়া করে হাসিমুখে উদ্বোধন করে যাবেন। ফুটওভার ব্রিজের হবু ঠিকাদারের চোখ চকচক করে উঠছে হয়তো। সন্তানের হাত ধরা অবস্থায় কত সন্তান মারা যাচ্ছে, তাদের সবার নামে পদচারী–সেতু হবে? তাদের পিতা-মাতারা হবে সেসবের গর্বিত উদ্বোধক? এভাবে মৃত্যুও চলবে আর চলবে পদচারী–সেতু বানাবার ঠিকাদারি? জীবন-মৃত্যুর ওগো ম্যানেজার, এ তোমার কেমন বিচার?
একটা মারণকলের মধ্যে আটকে পড়ে গেছি আমরা। কত কত অপঘাতের আশঙ্কা চারদিকে। কেবলই তরুণের, কেবলই কিশোরের মৃত্যু করে দিয়ে আমরাও মরে যাচ্ছি রোজ। এই ঢাকায় যখন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের জীবনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে আবার, তখন ইউরোপজুড়ে কিশোর-কিশোরীরা নেমেছে পৃথিবীর জীবন বাঁচাতে, কয়লা জ্বালানি বন্ধের দাবিতে। আমরা প্রাণীর দশায় পড়ে থাকা প্রাণবিক, তারা মানুষের মতো জীবন পাওয়ায় মানবিক। এমনই মানবিক যে নিউজিল্যান্ডে এখন মসজিদ পাহারা দিচ্ছে তরুণেরা, অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিমবিদ্বেষী সিনেটরের মাথায় ডিম ভাঙছে অকুতোভয় কিশোর। আমরা প্রাণীর মতো মারা পড়ছি, চালকেরা গরু-ছাগল চিনতে পারলেও মানুষ চিনতে পারছে না। জেব্রাক্রসিংয়ে মারা পড়ছে কিশোর।
সেবারের সড়কে নিরাপত্তা আন্দোলন বা এবারের সুবিচারের দাবি—কোনোটাই সরকারবিরোধী ছিল না। সরকার তবু তাদের দেওয়া কথা রাখতে পারেনি। আমাদেরই বানানো আইন যে বড়রা আমরা ভাঙছি, তা ছাত্রছাত্রীরা হাতেনাতে দেখিয়ে দিলেও আমরা লজ্জিত হইনি। পুরো জাতির হয়ে তারাই যে জীবনের দাবি নিয়ে এসওএস বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছিল, আমরা বড়রা ঠিকমতো তাদের পাশে থাকিনি। আমরা টিভি দেখেছি, ফেসবুকে ওরাংওটাং নৃত্য করেছি, বিবেকের ভার বুলির বাহার দিয়ে হালকা করেছি। কিন্তু আমাদের কোলে আমাদের হাতে ধরা অবস্থায় আমাদের সন্তানদের মৃত্যু আমরা থামাতে পারছি না। আমাদের তরুণেরা যেন সামষ্টিকভাবে পর্যায়ক্রমিক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। আমাদের পিতা–মাতারা সেসবের অসহায় প্রত্যক্ষদর্শী, সরেজমিন ভুক্তভোগী।
কাউকে একা দুষিয়ে লাভ নাই। এত মানুষ এ শহরে, এত গাড়ি রাজপথে, এত বেকারের শর্টকাট চাকরি পরিবহন খাতে! গত কয়েক মাসে খুব কড়াকড়ি করল ট্রাফিক পুলিশ। অনেক জরিমানা আদায় হলো, সেসবের ভগ্নাংশ দিয়ে প্রতিটি মৃত্যুর স্থানে একটি করে পদচারী–সেতু বানানোই যায়। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কেন আমরা হাহুতাশ আর গালিগালাজ ছেড়ে গঠনমূলক সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসি না। আমাদের কিসের অভাব? টাকার নাকি অভাব নাই, তাহলে কিসের অভাব?
আসলে দরদি লোক, যোগ্য লোক যোগ্য জায়গায় নাই। এমন লোক দেখা যাচ্ছে না যারা আন্তরিকভাবে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ নিয়ে সমাধানে হাত দেবে। সমস্যাটা কাঠামোগত, অর্থাৎ পুরো ব্যবস্থার। মৃত্যুগুলোকে তাই কাঠামোগত হত্যাই বলতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে যে কামান দেগেও মশা মারা সম্ভব হচ্ছে না। সড়কে সুশাসন আনায় বাধা দিয়েছিলেন যে শাজাহান খান, তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেও সড়ক ও নদীতে চলা সব পরিবহনশ্রমিকের নেতার আসনে গাঁট মেরে বসেই আছেন।
ভূমিকম্প হলে কাউকে বলতে হয় না, আত্মরক্ষায় সবাই ছোটে। আমাদের দেশে সামাজিক ভূমিকম্প হয়ে চলেছে একের পর এক, কিন্তু কী করছি আমরা? দেশ মানে মানুষ, উন্নয়ন মানেও মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ মানেও মানুষ। আমাদের সবার সন্তানকে যেহেতু বিদেশে পাঠাত পারব না, বিদেশও যেহেতু আর নিরাপদ নয়, সেহেতু আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব প্রত্যেককেই নিতে হবে। আমাদের মানুষ মনে করা হচ্ছে না, সাম্মানিক নাগরিক ভাবা হচ্ছে না, জনতার সন্তানদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ভাবা হচ্ছে না। মানুষের জীবন পেতে যদি চাই, তাহলে সবাই সবাইকে বলতে হবে, ‘আবার তোরা মানুষ হ’।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
faruk.wasif@prothomalo.com